ডাঃ এস. এম. মশিউর রহমান

অদম্য ইচ্ছাশক্তির গল্প: ডাঃ এস. এম. মশিউর রহমান:
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ছোট্ট গ্রাম বার্থী ইউনিয়ন। সবুজে ঘেরা এই শান্ত পল্লীতে একদিন জন্ম নিয়েছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ – ডাঃ এম. এম. মশিউর রহমান। গ্রামের মাটির গন্ধ আর নদীর বাতাসে বড় হওয়া সেই শিশুটি একদিন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের নাম উজ্জ্বল করবেন, তা হয়তো কেউ ভাবেনি তখন। কিন্তু তিনি পেরেছেন।
শৈশবের স্বপ্ন আর বাবার শিক্ষা
মশিউরের শৈশব কেটেছে সরলতা আর স্নেহের ছায়ায়। বাবা মরহুম মুজিবর রহমানের নীতিবোধ আর মা রিজিয়া বেগমের স্নেহের পরশ তাকে ছোট থেকেই মানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মা গৃহিণী হলেও তার মমতার পরশ আর বাবার নৈতিক শিক্ষা মশিউরের জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন, “মানুষের উপকার করাই জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।”
শহরের পথে প্রথম পদক্ষেপ
ছোট্ট গ্রাম ছেড়ে মশিউর চলে এলেন ঢাকায়। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ—সবই যেন অজানা এক জগত। ঢাকার মতিঝিল মডেল হাইস্কুল থেকে ১৯৯৮ সালে এসএসসি পাস করে দেখিয়ে দিলেন তার মেধার ঝলক। এরপর নটরডেম কলেজে ভর্তি হলেন। কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা তাকে এইচএসসিতে সাফল্য এনে দিল।
তবে এখানেই থেমে থাকার পাত্র নন মশিউর। তার স্বপ্ন ছিল মানুষের জীবন রক্ষা করার, চিকিৎসক হওয়ার। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পাড়ি জমালেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। ২০০৬ সালে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি বুঝলেন, চিকিৎসক হিসেবে তার আসল দায়িত্ব এখন শুরু।
দক্ষতার শিখরে আরোহণ
সাধারণ চিকিৎসক হয়ে থেমে থাকতে চাননি মশিউর। তিনি হতে চেয়েছিলেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি জটিল থেকে জটিলতর অস্ত্রোপচারেও মানুষের জীবনে সুস্থতার আলো এনে দেবেন। এই লক্ষ্যেই তিনি ২০১৫ সালে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান থেকে এমএস (অর্থোপেডিকস) সম্পন্ন করেন।
কিন্তু এখানেই তার শেখা শেষ নয়। আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান অর্জন করতে তিনি পাড়ি জমান বিদেশে:
– ২০২০ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর সাকরা ওয়ার্ল্ড হাসপাতাল থেকে আর্থ্রোপ্লাস্টি ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন।
– ২০২৩ সালে ভারতের বিখ্যাত আর্থ্রোস্কোপি বিশেষজ্ঞ ডাঃ রাজিব রোমনের কাছে থেকে আর্থ্রোস্কোপি ফেলোশিপ গ্রহণ করেন।
– ২০২৫ সালে ব্যাংককের বিখ্যাত Bhumibol Adulyadej Hospital থেকে AO Trauma Fellowship সম্পন্ন করেন, যেখানে তিনি আধুনিক ট্রমা ম্যানেজমেন্টের নতুন নতুন কৌশল শিখেছেন।
রোগীদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা
ডাঃ মশিউর রহমান শুধুমাত্র একজন দক্ষ সার্জনই নন, তিনি একজন মানবিক হৃদয়ের মানুষ। রোগীদের সাথে তার ব্যবহার, সহানুভূতি, এবং সেবার মানসিকতা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি সবসময় বিশ্বাস করেন, “একজন চিকিৎসকের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো রোগীর মনে আশা জাগানো।”
সামাজিক অবদান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ভাবেননি মশিউর; তিনি সবসময়ই চিন্তা করেন সমাজের জন্য কিছু করার। গ্রামের মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তার বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন তার গ্রাম বার্থী ইউনিয়নেও থাকবে আধুনিক চিকিৎসা সেবা, যেখানে গ্রামের মানুষ সহজেই সঠিক চিকিৎসা পাবে।
উপসংহার
ঢাকার ব্যস্ত শহরের আদাবরে এখন বসবাস করলেও, মশিউরের মন পড়ে থাকে তার শৈশবের গ্রাম বার্থীতে। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি একজন সফল অর্থোপেডিক সার্জন, একজন আর্থ্রোপ্লাস্টি এবং আর্থ্রোস্কোপি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তার বিনয়ী মনোভাব, মানবিক মূল্যবোধ এবং রোগীদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তাকে সবসময় মানুষের হৃদয়ে আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে।
ডাঃ এম. এম. মশিউর রহমান—একজন অদম্য ইচ্ছাশক্তির নাম, যার গল্প প্রমাণ করে যে সৎ ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম মানুষকে যে কোনো উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।